সূরা নাস বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ব্যাখ্যা এবং ফযিলত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সূরা নাস পবিত্র কুরআনের ১১৪ তম এবং সর্বশেষ সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৬, রুকু ১টি। সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছিল মদীনায়। তাই এটিকে মাদানী সূরা বলা হয়।
এই সূরার প্রথম আয়াত 'কুল আউযু বিরাব্বিন নাস'এর 'নাস' শব্দটি এর নাম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। নাস অর্থ মানুষ বা মানবজাতি।
হজরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
তোমার কি জানা নেই আজ রাতে আমার ওপর যে আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে এগুলোর মতো কোনো আয়াত এর আগে দেখাও যায়নি এবং শোনাও যায়নি। আর এগুলো হলো 'কুল আয়ুজু বি রাব্বিল ফালাক ও কুল আয়ুজু বি রাব্বিন নাস'।সহি মুসলিম ৮১৪
সূরা নাস আরবি
بِسمِ اللَّهِ الرَّحمٰنِ الرَّحيمِ
- قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ
- مَلِكِ ٱلنَّاسِ
- إِلَٰهِ ٱلنَّاسِ
- مِن شَرِّ ٱلْوَسْوَاسِ ٱلْخَنَّاسِ
- ٱلَّذِى يُوَسْوِسُ فِى صُدُورِ ٱلنَّاسِ
- مِنَ ٱلْجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ
সূরা নাস বাংলা উচ্চারণ
- কুল আ‘ঊযুবিরাব্বিন্না-স,
- মালিকিন্না-স,
- ইলা-হিন্না-স।
- মিন শাররিল ওয়াছ ওয়া-ছিল খান্না-স।
- আল্লাযী ইউওয়াছয়িছু ফী সুদূরিন্না-স।
- মিনাল জিন্নাতি ওয়ান্না-স।
সূরা নাসের বাংলা অর্থ
বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি মানুষের পালনকর্তার।মানুষের অধিপতির।মানুষের মা’বুদের।তার অনিষ্ট থেকে,যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে।যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
সূরা নাসের ব্যাখ্যা
'নাস' শব্দের অর্থ মানব জাতি। এ সূরার প্রথম তিন আয়াত-
কুল আ‘ঊযুবিরাব্বিন্না-স,
মালিকিন্না-স,
ইলা-হিন্না-স
এ তিন আয়াতে আল্লাহর মাহাত্ন্য বর্ণিত হয়েছে এবং উনার কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। এখানে আল্লাহকে বলা হয়েছে 'মানুষের পালনকর্তা, মানুষের অধিপতি, মানুষের উপাস্য'।
আর পরের তিন আয়াত-
মিন শাররিল ওয়াছ ওয়া-ছিল খান্না-স,
আল্লাযী ইউওয়াছয়িছু ফী সুদূরিন্না-স,
মিনাল জিন্নাতি ওয়ান্না-স।
এ তিন আয়াতে ঐ সকল খারাপ জ্বিন এবং খারাপ মানুষের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে যারা মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়।
এখানে জোরের সাথে বলা হয়েছে-
'যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে।
যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে'।
এখানে মূলতঃ গোপন জাদু-টোনা বা বান মারার কথা বলা হয়েছে।
মহানবী একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। আল্লাহর নির্দেশে জিবরাঈল (আঃ) এসে মহানবী (সাঃ)-কে জানিয়ে দিলেন যে, এক ইহুদী তাকে জাদু করেছে এবং যে জিনিস দিয়ে জাদু করা হয়েছে তা একটি কুপের মধ্যে পাথরের নিচে আছে। নবী (সাঃ) লোক পাঠিয়ে সে জিনিসটি উদ্ধার করে আনলেন, যাতে একটি সুতায় কয়েকটি গিট দেয়া ছিল। তখন তিনি সূরা নাস ও ফালাক দুইটি একসঙ্গে পড়ে ফুক দেন এবং গিটগুলো সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বিছানা থেকে ওঠেন।
সুতরাং গোপন জাদু-টোনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই সূরা পাঠ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই সূরার ভাবার্থের ভিতর আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লুকিয়ে আছে।
কিছু মানুষ কুমন্ত্রণা বা খারাপ পরামর্শের মাধ্যমে এক মানুষকে অন্য মানুষের সাথে অথবা এক দলকে অন্য দলের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত করিয়ে নিজেরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে মজা নেয় বা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। তাদের কুপরামর্শগুলো সহজ সরল মানুষের অন্তরে জাদু-টোনার মতই প্রভাব ফেলে তাদেরকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। এ সূরায় ঐ সকল খারাপ মানুষদের ব্যাপারেও খুব সাবধান থাকা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা রয়েছে।
আরো খোলাসা করে যদি বলা হয় বা এই সূরার মর্মার্থ একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়- যারা গোপনে একের কথা অন্যের কাছে লাগায় বা গোপনে অন্যের ক্ষতি করার বা অন্যের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে পরিবারে, সমাজে, গোত্রে বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে সালিশদারের ভূমিকা পালন করে, নের্তৃত্ব- কর্তৃত্ব হাসিল করে এবং দুই পক্ষের মাঝখানে থেকে আর্থিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করে তাদের ব্যাপারেও সাবধান থাকার ইংগিত পাওয়া যায়। আর আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া মানে হচ্ছে যে কোন সমস্যায় কোন ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শ না শুনে আল্লাহর প্রেরিত বাণী আল কোরআনে এবং আল্লাহর প্রেরিত রাসুলের হাদিসে সমাধান খোঁজার নির্দেশ রয়েছে।
এখানে আল্লাহর তিনটি সিফাত 'মানুষের পালনকর্তা, মানুষের অধিপতি, মানুষের উপাস্য' এই কথাগুলোর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে তোমরা যে খারাপ পরামর্শদাতাকে তোমাদের সমস্যা সমাধানের উপায় মনে করছ বা তার পরামর্শকে তোমাদের জন্য কল্যাণকর মনে করছ এবং তাকে ক্ষমতাবান মনে করছ আসলে সে নয় বরং তোমাদের পালনকর্তা, তোমাদের অধিপতি এবং তোমাদের মাবুদ হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী, তিনিই সকল সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সুতরাং কুপরামর্শদাতার কাছে নয়, সাহায্য চাইতে হবে আল্লাহর কাছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে উত্তম বুঝ দান করুন। আমীন
সূরা নাস পড়ার ফজিলত
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে স্বয়ং রাসুল সাঃ সূরা নাস এবং সূরা ফালাক পাঠের মাধ্যমে জনৈক ইহুদির জাদু থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। সুতরাং এই সূরার প্রধান ফজিলত হচ্ছে জাদু-টোনা থেকে রক্ষা পাওয়া।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি রাতে যখন ঘুমাতে যেতেন, তখন নিজের উভয় হাত এক সঙ্গে মিলাতেন। তারপর উভয় হাতে ফুঁক দিতেন এবং সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস পড়ে মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করে দেহের যতটুকু অংশ সম্ভব হাত বুলিয়ে নিতেন। এরূপ তিনবার করতেন। (সহি বুখারি)
আবু দাউদ এর ১৩৬৩ নং হাদিস মতে ফজর আর মাগরিবের ফরজ সালাতের পর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে পড়া সুন্নত। অন্যান্য ফরজ সালাতের পর একবার করে এই তিন সূরা পড়তে হবে।
সূরা নাস পড়লে শয়তানের অনিষ্ট ও যাদু থেকে হেফাজতে থাকা যায়। হাদিসে এসেছে,
‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যা সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়বে সে সকল বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকবে।
তিরমিযী, হাদীস।
সূরা নাসের দ্বিতীয় ফজিলত হচ্ছে- যদি এর অর্থ ও ব্যাখ্যা আপনার জানা থাকে তাহলে যখনি কেউ আপনাকে কুপরামর্শ দিবে তখনি এই সূরার কথা আপনার মনে পড়বে। তার কুপরামর্শ আপনার অন্তরে জাদুর মত প্রভাব ফেলতে পারবেনা এবং আপনি তার কুপরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন আর নিজেকে সম্ভাব্য সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।
--------